শিরোনাম

10/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

আপনার প্রতিষ্ঠানের প্রচারের জন্য বিজ্ঞাপন দিন।

মুখোশের আড়ালে



....................  মুখোশের আড়ালে....................


                   রাবিদ মাহমুদ চঞ্চল 


মুখোশ পরা মানুষ আমাদের চারপাশে ঘিরে আছে। ইতিহাসের পাতায় পাতায় মুখোশ পরা মানুষ ছিল আদিম কাল থেকে। কেউ কেউ মুখোশ পরা মানুষ গুলোকে মুনাফেক বলেও ডেকে থাকেন। অদূর ইতিহাসে পাতায় বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার রাজ প্রাসাদে ছিল মীরজাফর আলী খাঁ,মহাত্মা গান্ধীর প্রাসাদে নাথুরাম গডসে,ইন্দিরা গান্ধীর প্রাসাদে ছিলেন বিয়ন্ত সিং ও সতবন্ত সিং,শেখ মুজিবুর রহমানের প্রাসাদে ছিলেন খন্দকার মোশতাক, জিয়াউর রহমানের খুব কাছে মানুষ ছিল মেজর মঞ্জুর। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় সিরাজুদ্দৌলা থেকে জিয়াউর রহমান পর্যন্ত যত মহান মানুষ গুলো প্রান হারিয়েছে সবার ঘাতকরা ছিল তাদের ছত্র ছায়ায়। ঘাতকদের হাতে কিংবা তাদের ষড়যন্ত্রে ফাঁদে যারা প্রান হারিয়েছে তারা কেউ কোন দিন ভাবতেও পারিনি এই মানুষ গুলো তাদের জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দিতে পারে। অথচ তারা তাই করেছে যা ছিল কল্পনার দুঃসাধ্য। মুখোশ পরে এই মানুষ এমন ভাবে ঘটনার পটভূমি রচনা করেছে যে তাদের লক্ষ্য ভ্রষ্ট হয়নি।  সেকারণেই সুস্পষ্ট ভাবে বলা যায় এই মুখোশ পরা মানুষ গুলো জাত সাপের চেয়েও ভয়ংকর। 

১৭৫৭ সালে ২৩ শে জুন মীর জাফরের বিশ্বাস ঘাতকতার কারনেই ডুবে যায় বাংলার ভাগ্য আকাশের স্বাধীন সূর্য। মীর জাফর পুত্র মিরনের উপস্থিতিতে ২ জুলাই তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। 

১৯৪৮ সালের ৩০শে জানুয়ারি মহাত্মা গান্ধী বিড়লা হাউসের পিছনে উত্থিত লনের দিকে যাওয়ার ধাপের শীর্ষে পৌঁছেছিলেন। যেখানে তিনি প্রতি সন্ধ্যায় বহু-বিশ্বাসের প্রার্থনা সভা পরিচালনা করতেন। গান্ধী যখন মঞ্চের দিকে হাঁটতে শুরু করেন, গডসে গান্ধীর পথ ধরে ভিড় থেকে বেরিয়ে আসেন এবং গান্ধীর বুকে এবং পেটে তিনটি গুলি চালান। গান্ধী মাটিতে পড়ে যান। তাকে বিড়লা হাউসে তার কক্ষে ফিরিয়ে আনা হয় যেখান থেকে কিছুক্ষণ পরে একজন প্রতিনিধি তার মৃত্যুর ঘোষণা দেন। 

৩১ অক্টোবর ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গান্ধীর বিশ্বস্ত নিরাপত্তাকর্মী বিয়ন্ত সিং রিভলবার বার করে দিকে গুলি চালায়। প্রথম গুলিটা পেটে লেগেছিল। ইন্দিরা গান্ধী ডান হাতটা ওপরে তুলেছিলেন গুলি থেকে বাঁচতে। তখন একেবারে পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জ থেকে বিয়ন্ত সিং আরও দুবার গুলি চালায়। সে-দুটো গুলি তার বুকে আর কোমরে লাগে। ওই জায়গার ঠিক পাঁচ ফুট দূরে নিজের টমসন অটোমেটিক কার্বাইন নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সতবন্ত সিং। 

ইন্দিরা গান্ধীকে মাটিতে পড়ে যেতে দেখে সতবন্ত বোধহয় কিছুটা ঘাবড়ে গিয়েছিল। স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে ছিল। তখনই বিয়ন্ত চিৎকার করে সতবন্তকে বলে 'গুলি চালাও।' সতবন্ত সঙ্গে সঙ্গে নিজের কার্বাইন থেকে চেম্বারে থাকা ২৫টা গুলিই ইন্দিরা গান্ধীর শরীরে গেঁথে দিয়েছিল। বিয়ন্ত সিং প্রথম গুলিটা চালানোর পরে প্রায় ২৫ সেকেন্ড কেটে গিয়েছিল ততক্ষণে। নিরাপত্তা কর্মীরা ওই সময়টায় কোনও প্রতিক্রিয়া দেখান নি, এতটাই হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন সবাই। এভাবে চিরকালে ঠিকানায় পাড়ি জমান ইন্দিরা গান্ধী। 

শেখ মুজিবুর রহমানের অতিশয় স্নেহের পাত্র ছিলেন খন্দকার মোশতাক। এমনকি শেখ সাহেবকে হত্যার রাতে মোশতাক তার বাসা থেকে শেখ সাহেবের জন্য তার প্রিয় হাঁসের মাংস রান্না করে এনেছিলেন বলেও শোনা যায়। অথচ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট এই মোশতাকের হাত রঞ্চিত হয় শেখ মুজিবুর রহমানসহ তার পরিবারের রক্তে। 

মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের অতিশয় স্নেহের ও আস্থার পাত্র ছিলেন মেজর মঞ্জুর। জিয়াউর রহমানের সময় কালে যে কয়জন সামরিক কর্মকর্তা নিজেদের শক্তিধর হিসেবে উপস্থিতি জানান দিয়েছিলেন তার মধ্যে মেজর মঞ্জুর অন্যতম। জিয়াউর রহমান হত্যাকালীন সময় চট্টগ্রাম ডিভিশনের জিওসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন এই মঞ্জুর। উইকিপিডিয়া তথ্য মতে- ১৯৮১ সালের ৩০শে মে ভোরে জিয়া চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে অবস্থান করছিলেন। ভোর ৪টায় সেনাবাহিনীর অফিসারদের তিনটি দল চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজ আক্রমণ করে। আক্রমণকারী দলের মূল হোতা লে. কর্নেল মতিউর রহমান, লে. কর্নেল মাহবুব, মেজর খালেদ, এবং লে. কর্নেল ফজলে হোসেন সার্কিট হাউজে রকেট নিক্ষেপ করে ভবনের দেয়ালে দুটি গর্ত সৃষ্টি করার মাধ্যমে আক্রমণ শুরু করেন। আক্রমণের সময় জিয়াউর রহমানের বেশ কয়েকজন রক্ষী নিহত হন।

অফিসাররা সার্কিট হাউসের কক্ষগুলোতে জিয়াউর রহমানকে খুঁজতে থাকেন। মেজর মোজাফফর এবং ক্যাপ্টেন মোসলেহ উদ্দিন সর্বপ্রথম জিয়াকে খুঁজে পান। মোসলেহ উদ্দিন জিয়াকে জানান যে, তাকে তাদের সাথে সেনানিবাসে যেতে হবে। এরপর কর্নেল মতিউর রহমান আরেকটি দল নিয়ে উপস্থিত হন এবং জিয়াকে অনেক কাছ থেকে একটি এসএমজি দিয়ে গুলি করে।

জিয়া গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে যাওয়ার পর মতিউর জিয়ার মুখমন্ডল ও ধড়ে গুলি চালিয়ে তাকে বিকৃত করে। এতে তার একটি চোখ বেড়িয়ে পড়েছিল বলে জানা যায়। সার্কিট হাউসে হামলা ২০ মিনিটেরও কম সময় স্থায়ী হয়। জিয়াকে হত্যার পর আক্রমণকারীরা চট্টগ্রাম সেনানিবাসে ফিরে আসে। জিয়াউর রহমানসহ তার দুই রক্ষী, কর্নেল আহসান এবং ক্যাপ্টেন হাফিজের মরদেহ একটি সামরিক পিকআপ ভ্যানে তুলে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হয়।

চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে জিয়াউর রহমানকে হত্যার খবর ভোর সাড়ে চারটার দিকে পেয়েছিলেন মেজর জেনারেল মঞ্জুর। তিনি তখন চট্টগ্রামের জিওসি। হত্যাকাণ্ডে সরাসরি যুক্ত না থাকলেও চট্টগ্রামের কমান্ডিং অফিসার হিসেবে মঞ্জুর পুরো ঘটনার দায়ভার নিজের কাঁধে নেন।

তবে এ কথা প্রতিষ্ঠিত যে, তিনি এ বিদ্রোহের অন্যতম প্রধান পরিকল্পনাকারী ছিলেন। প্রেসিডেন্টকে হত্যার পর মঞ্জুর সারাদেশে মার্শাল ল’ জারিসহ চার দফা দাবি পেশ করেন। ঢাকার সঙ্গে চলে দরকষাকষি। সব মিলিয়ে জিয়াউর রহমানের জীবন অবসানে মূল দায়ী  হিসেবে মেজর মঞ্জুর নাম বারংবার আলোচনায় আসতে থাকে যা এখনো চলমান।

এখন প্রশ্ন হলো বর্তমান সদ্য ছাত্র-জনতার বিজয়ের পর থেকে মুখোশ পরা মানুষ গুলো আরও সোচ্চার হয়ে উঠতে শুরু করেছে। দল বদলে সমর্থন বদলে নিজেদের অতি আপন(ক্ষমতাসীন বা যাদের ক্ষমতায় আসার অপার সম্ভবনা আছে) ঘরনার লোক হিসেবে উপস্থাপন করার জন্য দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছে। প্রকাশ্য দল করা মানুষ গুলোর মধ্যে থেকে অনেকই দল ত্যাগ করবেন এটা অযাচিত প্রশ্ন নয়। তারা দল ছেড়ে ক্ষমতাসীন বা যাদের ক্ষমতায় আসার অপার সম্ভবনা আছে তাদের সাথে অংশ নিলেও তাদেরকে নিয়ে সমস্যা খুব হবে বলে মনে হয় না, কারন তাদেরতো প্রকাশ্য চিহ্নিত করা যাবে বা চিহ্নিত হবে হাইব্রিড হিসেবে। নব্য হিসেবে চিহ্নিত থাকবেন দলে। তাদের ক্ষেত্রে সাবধান থাকতে হবে বা সাবধান হওয়া যাবে কিন্তু মুখোশ পরা মানুষ গুলো চিহ্নিত করা যেমন কঠিন তেমনি এদের নিয়ন্ত্রণ করাও কঠিন। মুখোশধারী লোককে আমরা প্রথম অবস্থায় ভালো বলে চিনলেও পরবর্তীতে তাদের আসল রূপ যখন আমাদের সামনে উন্মোচিত হয় তখন আমরা সবাই অবাক হয়ে যাই। কারণ প্রথম অবস্থাতে কোন মানুষের বোঝায় উপায় নেই যে এই মানুষের মনের ভিতর এতটা খারাপ দিক লুকিয়ে ছিল। আসলে এসব মানুষকে যখন আমরা চিনতে পারি তখন আমাদের অনেকটা সময় পার হয়ে যায়। তখন এইসব মুখোশধারী মানুষ আমাদের অনেক বড় ক্ষতি করে ফেলে। অবশ্য আমাদেরও প্রথম অবস্থাতে দেখে চেনার উপায় কখনোই ছিল না। আসলে মানুষ ভালো হবে কিনা খারাপ হবে তার নির্ভর করে তার পরিবার এবং প্রকৃতির উপর।  কিন্তু এই মুখোশধারী লোককে চেনার কখনো কোনো উপায় নেই। এই মুখগুলো ভালো পরিবেশ এবং ভালো পরিবার পেয়েও তার মধ্য দিয়ে যে কিভাবে খারাপ মানুষ হিসেবে সমাজে বিবেচিত হয় এর প্রধান কারণ হলো তাদের লোভ। মানুষকে খারাপ দিকে নিয়ে যাওয়ার সবচেয়ে প্রধান কারণ হলো মানুষের লোভ। মুখোশধারীরা ভালো মানুষ গুলোকে নষ্ট করতে লোভের টোপ পেতে থাকেন। এই পৃথিবীতে লোভে পড়ে মানুষ খারাপ থেকে আরও খারাপ পরিণত হয়। আসলে আপনি কোন ভালো ব্যক্তিকে বারবার লোভ দেখাবেন অর্থ সম্পত্তির লোভ দেখাবেন তাহলে হয়তোবা প্রথম অবস্থাতে সে বারণ করলেও এই লোভের বসে সে কিন্তু সেই খারাপ দিকটি গ্রহণ করে জীবনে ধনী হতে পারে। পৃথিবীতে ভালো খারাপ নিয়েই জীবজগৎ পূর্বকাল থেকে চলে গেছে। আর পৃথিবীতে যদি সবাই ভালো মানুষ হয়ে চলাফেরা করতো তাহলে এই পৃথিবী কিন্তু স্বর্গের থেকেও অনেক বেশি সুন্দর হতো। কিন্তু এই কিছু কিছু মুখোশধারী খারাপ লোকের জন্য এই পৃথিবীটা নরকের মতো মনে হয় আমাদের সকলের কাছে। 

তা যাই হোক অতিসম্প্রতি আমাদের বাংলাদেশ নব স্বাধীনতা লাভ করেছে। ছাত্র-জনতার বিজয়ের ধ্বনি বাজছে। এই বিজয় ধরে রাখার দায় দায়িত্ব আমাদের সকলের। কিন্তু এসময়টা আমাদের খুবই সচেতন থাকার প্রয়োজন। আমাদের চারপাশে গিজগিজ করছে মুখোশধারীরা। ছদ্মবেশ নিয়ে তারা ঢুকে পড়বে বা পড়ছে আমাদের ছাত্র-জনতার জয়কে ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য। দেশের বর্তমান পরিস্থিতি অধিকাংশই অসৎ কর্মকান্ড মুখোশধারীদের দ্বারাই সংঘটিত হচ্ছে একথা বলতে দ্বিমত পোষণ করার কোন সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি না। সুতরাং এখনি সময় মুখোশ পরা সাধু বেশী শয়তান থেকে সাবধান, নিজেদের কোন ভাবে মুখোশের আড়ালে থাকা মানুষ গুলোর মাঝে হারাতে দেওয়া যাবে না। তা না হলে আবারও পস্তাতে হবে আমাদের! হারিয়ে যেতে হবে অন্ধকারের অতল গহব্বরে।

লেখকঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট

Post a Comment

0 Comments